কৃষ্ণভাবনামৃত ভাববাদ? পলায়নবাদ? Page-146
কৃষ্ণভাবনামৃত ঃ ভাববাদ? পলায়নবাদ?
আমরা দেখেছি , কৃষ্ণভাবনামৃত যথার্থ বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। পক্ষান্তরে জড়বাদের ভিত্তি কল্পনাশ্রয়ী বিশ্বাস, অনুমান। সেজন্য, জড়বাদ, জড় আসক্তি মানুষকে ক্রমশঃ গভীর হতে গভীর মায়ামোহে আচ্ছাদিত করতে থাকে, তমসাবৃত হয় চেতনা (জড়বিদ্যা যত মায়ার বৈভব)।
কৃষ্ণভাবনামৃত প্রকাশ করে উজ্জ্বল জ্ঞানালােক, শাশ্বত বাস্তবতা আত্মস্বরূপ,ভগবৎস্বরূপ, চিন্ময় নিত্য ভগবদ্ধাম, শুদ্ধ ভগবদ্ভক্তি, প্রেম হৃদয়ের সবচেয়ে সুকোমল সুস্নিগ্ধ বৃত্তি —এইগুলির বিকাশই প্রকৃত মনুষ্যত্ব ;অন্ধ জড়বাদী হওয়া জীবনের পূর্ণাঙ্গ রূপ নয়। ভগবৎ প্রেমশীলতাই জীবনের প্রকৃত সৌকর্য-সৌন্দর্য প্রকাশক প্রভা।
আত্মা জড় বস্তু নয়, তাই ভালবাসা-আবেগ শুন্য নয়। এই প্রেমাবেগ পরিশীলিত হলে ভগবমুখী হয়, দিব্য আনন্দসিন্ধুর সন্ধান পায়। এই বৃত্তির বিজ্ঞান গ্রন্থ ভক্তিরসামৃত সিন্ধুতে সেই আনন্দাম্বুধিতে সন্তরণের নির্দেশিকা। কে বঞ্চিত থাকবেন?
মহাযােদ্ধা অর্জুনের যুদ্ধ না করার দার্শনিক ভাববিলাস ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদগীতায় উপদেশের মাধ্যমে বিধ্বস্ত করেন। ক্ষুদিরাম-বিনয়-বাদল-দীনেশ-নেতাজী-ভগৎ সিং অরবিন্দ গীতা থেকে প্রেরণা গ্রহণ করে অসমসাহসিক যুদ্ধে ব্রতী হন – তারা পলায়নবাদী (Escapist) কিংবা ভাববিলাসী (Sentimental) ছিলেন না। ভগবদগীতা ভাববিলাস সৃষ্টি করেনা, এটি প্রকৃত বাস্তবজ্ঞানের ভিত্তি, জীবনের প্রকৃত নির্দেশিকা।
বাস্তব সমস্যাগুলাে থেকে, বাস্তব জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে নাকি মানুষ আধ্যাত্মিকতার আশ্রয় নেয়, অলীকতার মধ্যে শান্তি খোঁজে -এমন অভিযােগ নিরেট জড়বাদীর। ব্যাপারটা ঠিক বিপরীত । জীবনের প্রকৃত সমস্যা মৃত্যু।
বিভীষিকাময় এই ভয়ংকর সমস্যা সমাধান করতে না পেরে তা থেকে পলায়নের জন্য জড়বাদীরা নানারকম ‘ইজম উদ্ভাবনে, বৌদ্ধিক বিতন্ডায়, কৃত্রিম বিপ্লবে, কল্পসাহিত্যে-কাব্যে, জড় সম্পদ সঞ্চয়ে এমনকি মাদকাসক্তি, কদাচারের আশ্রয় নেয়।
এভাবে আত্মবিস্মৃত থাকা, আত্মপ্রবঞ্চনা ও আত্মহনন সহজ। কৃষ্ণভাবনামৃত মানুষকে প্রখর বাস্তবতার মুখােমুখি দাঁড় করায়, জীবনের প্রকৃত সমস্যা জরা-ব্যাধি-মৃত্যু-জন্ম যন্ত্রণা (জন্ম-মৃত্যুজরা ব্যাধি-দুঃখ-দোষানুদর্শনমভ. গী ১৩/৯), এই জগৎ দুঃখময় ও ক্ষণস্থায়ী (দুঃখালয় অশাশ্বত-ভ.গী.৮/১৬)। ভগবদগীতা এর সমাধান দেয়।
শ্রীল রূপ গােস্বামী যেমন বলেছেন, কৃষ্ণভাবনামৃত শুষ্ক বৈরাগ্য নয়, যুক্ত বৈরাগ্য শিক্ষা দেয় – সব কিছুকে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় ব্যবহার করা যায় ? ল্যাপটপ, সেলফোন, গাড়ী, প্লেন, যন্ত্রপাতি, ইমারত, সমস্ত কিছুকে। কেননা সবই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শক্তিপ্রসূত। এমনকি মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্রকেও, শ্রীল প্রভুপাদ যেমন বলেছেন।
বর্তমানে সারা বিশ্বের কৃষ্ণভক্ত বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনীয়ার, স্থপতি বা আর্কিটেক্ট, ভাস্কর বা স্কলপটর তাঁদের দক্ষতা প্রয়ােগ করছেন শ্রীকৃষ্ণের সেবায়, কৃষ্ণকর্মে ব্যবহৃত হচ্ছে বিজ্ঞানপ্রযুক্তি।
পলায়ন নয়, প্রবল সেবাতৎপরতার ফলে ঘটছে পারমার্থিক নবজাগরণ। যেমন বিশ্বে প্রতি মিনিটে ৩০০ পাত্র কৃষ্ণপ্রসাদ বিনামূল্যে বিতরিত হচ্ছে, প্রতি মিনিটে মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে কোন না কোন পারমার্থিক গ্রন্থ। গড়ে উঠছে দিব্যমন্দির, কৃষিখামার, পারমার্থিক।
স্কুল-কলেজ, ইকো-ভিলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, প্লানেটোরিয়ম, ইত্যাদি। সবই শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিবেদিত, কৃষ্ণচেতনা বিস্তারে নিয়ােজিত হচ্ছে। শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টিবিধানের জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণাও দোষনীয় নয়;বিজ্ঞান প্রযুক্তি-শিল্প-ভাস্কর্য চিত্রকর্ম কলাবিদ্যা সবকিছুকে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় ব্যবহার করে বিশ্বের মানুষ তাদের গৃহকে শিল্পসৌষ্ঠবপূর্ণ, তাদের বেশভূষাকে রুচিশীল ও রমণীয়, তাদের সংস্কৃতিকে যথার্থ শােভন ও নান্দনিকতাপূর্ণ করে তুলতে পারেন, তাদের স্কুল-কলেজকে ভগবৎ-ভাবনাময় বিদ্যামন্দিরে পরিণত করে তাদের উত্তরসুরীদের হাস্যোজ্বল, প্রসন্ন, বােধদীপ্ত করে গড়ে তুলতে পারেন।
বিশ্ব জুড়ে রচিত হচ্ছে সেই ইতিহাস, আগামী দিনের ভিত্তি। যারা এই মহান epoch-making history(প্রভুপাদ)-নবযুগ সৃষ্টির ইতিহাসের প্রবল কর্মযজ্ঞে বিমুখ, তারাই প্রকৃত ‘পলায়নবাদী। তাদের সাদর আমন্ত্রণ – গন্ডিবদ্ধ জীবনে আপনবৃত্তে আত্মকেন্দ্রিক থাকার দিন ফুরিয়েছে, আসুন আমরা যুথবদ্ধ হয়ে শ্রীকৃষ্ণসেবায় নিয়ােজিত হই, ভগবদগীতার সূত্র অনুসারে অপরের কল্যাণ করি, নিজ জীবন ধন্য করি।।
Comments
Post a Comment