পরিযায়ী পাখীর আছে ম্যাগনেটাইড-এর হাইটেক কম্পাস ||Page-98
পরিযায়ী পাখীর আছে ম্যাগনেটাইড-এর হাইটেক কম্পাস ?
প্রশান্ত কিংবা অতলান্তিক মহাসাগরের আদিগন্ত বিস্তৃত কুল-কিনারাহীন জলরাশির মধ্যে রেডার-কম্পাসবিহীন একটি জাহাজের কল্পনা করুন। হাজার হাজার মাইল একটি নির্দিষ্ট বন্দরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিরে আসার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ – যদিও সেটি পরিচালনায় রয়েছে পৃথিবীর উন্নততম মস্তিষ্কের অধিকারী মানুষ।
মানুষের মস্তিষ্ক 1400 কিউবিক সে.মি. পক্ষান্তরে একটি পাখীর মস্তিষ্ক 1-2 কিউবিক সে.মি, ওজন 1 থেকে 3 গ্রাম। কিন্তু এতেই অসাধ্য সাধন করে তারা অতিক্রম করে মহাসাগর, সঠিক নিশানা ও লক্ষে, প্রতিবছর।যেমন সুদুর রাশিয়ার সাইবেরিয়ার পাখী আসে ভারতে, আলিপুর চিড়িয়াখানায়, সাঁতরাগাছির ঝিলে।।
পারাবতঃ ঘরে পােষা পায়রাকে বিজ্ঞানীরা একটি আলােহীন অন্ধকার বাক্সে বন্দী করে ৪০-৫০ কিলােমিটার দুরে ছেড়ে দেখেছেন, তারা নির্দিষ্ট ঠিকানায় নির্ভুলভাবে ফিরে আসে। এমনকি তাদের চোখে পাঁচ ফুটের বেশি দূরের কিছু দেখা যাবে না এমন ঘষা কাচের লেন্স লাগিয়ে ৪০-৫০ কিমি দূরে ছেড়ে দিয়ে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা সঠিক ঠিকানায় তাদের আপন বাসায় ফিরে এসে বাসা দেখতে না পেয়ে তাদের উপরে ঘুরপাক খেতে দেখা গেছে। এজন্য পায়রা ছিল আগে একবিশ্বস্ত সংবাদ বাহক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতে ব্রিটিশ সরকার আড়াই হাজার প্রশিক্ষক সৈন্য নিয়ােজিত করেছিল হাজার পায়রাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল বার্তাবহনের কাজে।
কিন্তু বিশ্বে এমন সব পাখী রয়েছে, যাদের কাছে পায়রার এই ক্ষমতা নিতান্তই তুচ্ছ হয়ে যাবে।।
আর্কটিক টার্ন (Arctic tern), বৈজ্ঞানিক নাম স্টেনা প্যারাডিসাইয়া , একটি সামুদ্রিক পাখী। এই পাখীটি মাঝারি মাপের, ৩৩-৩৯ সেমি. লম্বা। এই পাখী পথিবীর সবচেয়ে বেশি দিনের আলাে দেখে। আন্টার্কটিকা বা কুমেরু মহাদেশে ৬ মাস দীর্ঘ দিনের সময় শেষ হলে এরা পাড়ি দেয় উত্তর মেরু ও সংলগ্ন অঞ্চলের দেশগুলির উদ্দেশ্যে, মহাসাগরের উপর দিয়ে উড়ে যায় প্রায় আঠারাে হাজার কিলােমিটার। উত্তর মেরুর দিন শেষ হলে এরা পুনরায় পাড়ি দেয় পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর উদ্দেশ্যে।
তাদের বাৎসরিক এই মহাকাব্যিক ভ্রমণে তারা আকাশ পথে নির্ভুল দিক নিশানায় অতিক্রম করে প্রায় ৩৬ হাজার কিলােমিটার অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি।
আর্কটিক টার্নের অবিশ্বাস্য উড্ডয়ন ক্ষমতার প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন ১৯৮২ সালের একটি পরীক্ষায়। পূর্ব ব্রিটেনের নর্দামবারল্যান্ডের সাগর উপকূলের ফার্ণ আইল্যান্ডে পক্ষী বিজ্ঞানীরা ১৯৮২-র গ্রীষ্মে তখনও উড়তে শেখেনি এমন একটি বাচ্চা আর্কটিক টার্ন পাখীকে রিং পরান। পাখীটি তার ঠিক তিন মাস পর ১৯৮২-র অক্টোবরে অষ্ট্রেলিয়ার মেলবাের্ণে পৌঁছায়, এই সমুদ্র যাত্রায় সে অতিক্রম করে ২২,০০০ কিলােমিটার, উড়তে শেখার অব্যবহিত পরই। দক্ষিণ মেরুর বােড়নার নামক পরিযায়ী পাখী সােজা উড়ে উত্তর মেরুতে যায়, আবার ফিরে আসে দক্ষিণ মেরুতে। অতিক্রম করে ৩৬০০০ কিমি. – প্রতিবছর, নির্ভুল লক্ষ্যে, নির্ভুল গন্তব্যে।।
এছাড়া আরাে বহু প্রজাতির পাখী রয়েছে, যারা পরিযায়ী। যেমন সাইবেরিয়া থেকে প্রতি বছর শীতকালে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের নির্দিষ্ট স্থানে আসে পরিযায়ী পাখীরা। প্রশ্ন হচ্ছে, হাজার হাজার কিলােমিটার দিকচিহ্নহীন মহাসাগরের জলরাশির উপর দিয়ে লক্ষ্যের দিকে এরা উড়ে যায় কিভাবে?
কিছু বিজ্ঞানী বলেন, ধ্রুবতারা দেখে। কোন পাঠশালায় তারা এ-বিষয়ে শিক্ষা নিল? বাচ্চা আর্কটিক টার্ন পাখীর তাে সমুদ্র ও তার ওপারের দেশ সম্বন্ধে কোন পূর্বধারণাও ছিল না।
কিছু বিজ্ঞানী বলছেন, পাখীরা ব্যবহার করে এক অতি উন্নত ম্যাগনেটিক কম্পাস ব্যবস্থা। পাখীদের মস্তিষ্কে রয়েছে চৌম্বক ধর্ম সম্পন্ন ম্যাগনেটাইড ক্রিস্টাল, যা Iron-II/III Oxide -এ তৈরী। পাখীদের 1-2 কিউবিক সেমি, অর্থাৎ আঙুলের ডগার আকৃতির ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের মধ্যে এই ম্যাগনেটাইড ক্রিস্টাল লাইন রয়েছে, যার সাহায্যে তারা পৃথিবীর চৌম্বক বলয় বা ম্যাগনেটিক পােলারিটি বুঝতে পারে, এবং যার সাহায্যে রাতের অন্ধকারেও নির্ভুল নিশানার দিকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে একটানা উড়ে যেতে পারে।
যদি এটা সত্যিও হয়, তাহলে ‘আকস্মিকভাবে’ পাখীর পূর্বপুরুষেরা (ডারউইনের মতে পেঙ্গুইন পাখীতে পরিণত হয়েছে) কোন ল্যাবরেটোরিতে গবেষণা করে পৃথিবীর চৌম্বক ধর্মের কথা জানতে পেরেছে?
কিভাবে সেই চৌম্বক ম্যাপ কাজে লাগাতে খাদ্য খাবার থেকে সংগ্রহ করে মস্তিষ্কে তৈরী করেছে নির্দিষ্ট মাপের ও ক্ষমতার ম্যাগনেটাইড ক্রিস্টাল ?
মানুষের তৈরী বিমানের অত্যাধুনিক রেডার ব্যবস্থাতেও মাঝে মধ্যে গােলযােগ দেখা দিলে প্লেন ভুল করে নেভিগেশানে, কিন্তু এভাবে বিগড়ায় না পরিযায়ী পাখীর রেডার।।কিন্তু শুধু পাখীরাই নয়। হাজার হাজার কিলােমিটার নির্ভুল লক্ষ্যে চলার অভ্যাস আছে অন্য অনেক প্রজাতির। তাদের এই আচরণ আজও জীববিজ্ঞানের বিস্ময়, ‘আনসলভড় মিস্ট্রি । দু’ একটি নমুনা দেওয়া যেতে পারে।।
Comments
Post a Comment