আহার, চেতনা—জীবনের অভিযাত্রা।PAGE-261
আহার, চেতনা—জীবনের অভিযাত্রা।PAGE-261
আমিষ ও নিরামিষ —দুইরকম আহার্য যে দুইরকম চেতনা, স্বভাব উৎপন্ন করে, সেটির প্রমাণ পেতে আপনি প্রকৃতির পাঠশালায় আসুন। বাঘ-সিংহ-নেকড়ে-চিতা —এইসব মাংসাশী জীবের স্বভাবের সাথে হাতি-গন্ডার-গরু-হরিণের স্বভাবের লক্ষণীয় পার্থক্য রয়েছে। যদিও বাঘ সিংহকেও প্রীতিপূর্ণ প্রশিক্ষণ দিয়ে বন্ধু করে তােলা যায়, কেননা প্রত্যেক দেহ-পােশাকের মধ্যে বাস করছে প্রেম-শীল আত্মা। তবু বাহ্যত, খাদ্য চেতনাকে প্রভাবিত করে।
পরীক্ষা-১ঃ কুকুর দুরকম খাবারই খেতে পারে, তাই খাদ্যের প্রতিক্রিয়া পরীক্ষার জন্য কুকুর আদর্শ হতে পারে। দশটি একই জাতের কুকুরকে A ও B গ্রুপে বিভক্ত করে A গ্রুপকে কেবল মাংস ও জল এবং B গ্রুপকে দুধ ভাতখেতে দেওয়া হােক। ৬ মাস কিংবা এক বছর পর মাংসাশী গ্রুপ ও নিরামিষাশী গ্রুপ -এর কুকুরদের স্বভাবের ক্রোধ ও হিংস্রতার মাত্রা পরীক্ষা করুন। ফল সহজেই অনুমেয়।
বাস্তব দৃষ্টান্ত বাঘ-সিংহ এবং হাতি-গন্ডার। জলে নীল তিমি সবচেয়ে বড় প্রাণী, কিন্তু নিরামিষাশী, অপেক্ষাকৃত শান্ত। কিন্তু কিলার হােয়েল’ বা ঘাতক তিমি চেহারায় অনেক ছােট, মাংসাশী, তুলনায় অনেক হিংস্র।
পরীক্ষা-২ঃ ১০০০-এর মতাে স্কুল বা কলেজের ছাত্র থাকে, এমন দুটি আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বেছে নেওয়া হােক। এবার A শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদিত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর সাত্ত্বিক আহার্য দেওয়া হােক। B শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের অঢেল মাংস, তামাক ও অন্যান্য নেশা করতে দেওয়া হােক। ২ বছর পর স্বভাব-আচরণ পরীক্ষার স্টন্ডার্ড নিয়মনীতি নির্ধারণ করে উভয় গ্রুপের ছাত্রদের আচরণ-মানসিক অবস্থা ইত্যাদি মূল্যায়ন করা যেতে পারে। চিন্তা-চেতনায় পার্থক্য সহজেই সুস্পষ্ট হবে।
আহার চেতনা স্বভাব-মন-বুদ্ধিকে কিভাবে প্রভাবিত করে, ভগবদগীতায় তার তত্ত্ববিজ্ঞান বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞানসম্মত রিসার্চ স্টাডিতে এর সত্যতা প্রতিপাদিত হতে পারে সহজেই। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে নিরামিষ আহারই স্বভাব নিয়ন্ত্রণের একমাত্র অনুঘটক বা ফ্যাক্টর। তবে মানুষের চেতনা অত্যন্ত সংবেদনশীল, সেখানে মাংসাহার-নেশার ফলে স্বভাবে হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, ঈর্ষা সংক্রমিত হতে বাধ্য।
পক্ষান্তরে চিন্ময় ভগবৎ-প্রসাদ সুপ্ত পবিত্র চেতনাকে জাগ্রত করে। চেতনাস্বরূপতঃ ভগবদ ভাবনাময় ও পবিত্র।
প্রশ্ন উঠবেঃ বেশ, কিন্তু হিংস্রতা বৃদ্ধি পেলে ক্ষতি কিসের? ক্ষতি কিছু নেই, যদি জীবনের উদ্দেশ্য কিছু না থাকে, কিংবা যদি কেবল খাওয়ার জন্য বাঁচা’ -ই থাকে উদ্দেশ্য। জীবনপদার্থটি ধ্বংসশীল না হওয়ায় প্রতিক্রিয়া বয়ে নিয়ে যেতে হয় দেহের ধ্বংসের পরেও। চেতনাকে যেকোন রঙে রাঙানাে যায়। পশুরক্তে রঞ্জিত চেতনা স্বভাবতঃই হত্যা ও রক্তপাতের পরিবেশে প্রবেগ বা প্রবৃত্তির (Propensity) মুক্তি বা চরিতার্থতা চাইবে। সেজন্য প্রকৃতির বদান্যতায় পেতে হবে মাংসাহারের উপযােগী মাংসাশী দেহ। চেতনা অনুসারে দেহ লাভ হয় —পরম বিজ্ঞান গ্রন্থ ভগবদগীতার তথ্য।।
ভগবদ্গীতা অনুসারে, তিন রকমের আহার্য চেতনায় প্রকৃতির তিনটি গুণ সঞ্চারিত করতে সাহায্য করে। বদ্ধাবস্থায়, প্রকৃতির তিনটি গুণ সত্ত্ব-রজ-তমের বিভিন্ন মাত্রায় মিশ্রণ বিভিন্ন ধরনের স্বভাব উৎপন্ন করে। সত্ত্ব গুণ জ্ঞান-উন্মেষক ও প্রকাশক; রজোগুণ প্রবল উদ্যম, কর্মপ্রয়াস ও ভােগ প্রবৃত্তি উৎপন্ন করে এবং তমােগুণ প্রমাদ বা অজ্ঞানতা ও আচ্ছন্নতা, নিদ্রা ও আলস্য উৎপন্ন করে।
পশুর দেহ অস্পৃশ্য, অমেধ্যম (ভ.গী -১৭/১০), এবং সেটি তমােগুণ উৎপন্ন করে (অমেধ্যমতামস প্রিয়ম)। আর চেতনা তমােভাবাপন্ন, তামসিক হওয়ার পরিণতি কি? অধােগচ্ছন্তি তামসা (ভ.গী -১৪/১৮)। জীবনান্তে মনুষ্যেতর প্রজাতিতে, মাংসাহারী প্রজাতির জীবদেহে জন্ম হয়। অধো গচ্ছত্তি, নীচের দিকে গমন। মানব জন্মের সুযােগ নিয়ে মাংসাশী পশুর খাদ্য আহারের এটাই স্বাভাবিক পরিণতি—মাংসাশী পশুর দেহ লাভ।
মানবদেহ পশুর অনুকরণের জন্য নয়, আত্মজ্ঞান লাভের জন্য, আধাত্মিক চেতনা বিকাশের জন্য। প্রকৃতির নিয়ম অমােঘ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জন্য আমরা সাহসী ও গর্বিত হতে পারি, কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম লঙঘন করতে পারি না – সেটি মৃত্যুর মতােই চরম ও অমােঘ। তমােগুণ বৃদ্ধি পেলে নিম্নতর প্রজাতিতে অধঃপতিত হতেই হবে — অর্জুনকে সেই নিয়মের কথাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানাচ্ছেন অর্জুনের মাধ্যমে বিশ্বের মানুষকে। জে বরােনস্কি ‘টেকনােলজি ফর ম্যানকাইভ’ প্রবন্ধে গর্ব করেন --মানুষ প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে প্রকৃতিকে জয় করেছে। কিন্তু প্রকৃতির টাইম-ফোর্স তাঁকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে প্রকৃতি আছে, বরােনস্কি নেই স্বদেহে। কে কাকে জয় করেছে সহজেই অনুমেয়। অতএব মিথ্যা প্রলাপ বকে প্রকৃতির নিয়মকে প্রতিহত করা যায় না। খাদ্যের প্রতিক্রিয়া অব্যর্থ ও অমােঘ সত্য।
Comments
Post a Comment